আবারও টুল ভেঙ্গে গেল। আগেরবারতো আমার স্বাস্থ্য ছিল। সেটা না হয় মানা যায়। কিন্তু, এখন আমার এই চিকনা-পটাশ দেহটার ভাঁড় সহ্য হল না। যাক দ্বিতীয় বারের মত বেঁচে গেলাম। কিন্তু, বাসায়তো আবার বকা-ঝকা শুনতে হবে। কি বলবো “আত্মহত্যা করতে গিয়ে টুল ভেঙ্গে পড়ে গেছি”। নাহ, ব্যাপারটা নিজের কাছেই কেমন হাস্যকর মনে হচ্ছে। যাক ব্যাপার না, আদালতে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলে দিব। কিন্তু, আর আধ ঘণ্টার মধ্যে যে আমাকে স্কুলে থাকতে হবে। এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে কিভাবে যে কি করবো বুঝতে পারছি না। আপাতত আত্মহত্যার গ্লানিটা গোসলখানার বাল্বের উপর ঝারলাম। কি আর করবো, পানি মেরে ফুটাইয়া ফেলছি।
যা হবার তাই হল। পরীক্ষার আগ মুহূর্তে উদ্ভট কাজ করলে যা হয় আর কি। পরীক্ষার খাতায় বড় বড় তিনটা শূন্য। না, শুধু শূন্য না। তারপরে, তিনের পিঠে সাত আছে। মাস্টার মশাইও বড় আজিব। প্রথমে তিনটা শূন্য দেওয়ার কি দরকার? কষ্ট করে প্রথমে তিনটা শূন্য না দিয়ে তিনটা নাম্বার বাড়িয়ে দিলেই হত। অন্তত পক্ষে পাশ করতে পারতাম। এবার আর বাঁচার উপায় নেই। অভিভাবক আনতে হবে। কিন্তু, সেতো মহা ঝামেলা। বুদ্ধি একটা আছে। স্কুলের বাইরে চটপুটিওয়ালা। বয়সে আমাদের চেয়ে খুব একটা বেশি না। সবাই তাকে মামা বলে। সবাই তার ভাগিনা। অভিভাবক মিটিংএ অনেকেই তাকে হায়ার করে। অভিভাবক হিসেবে স্বাক্ষর প্রতি বেশিনা মাত্র পঞ্চাশ টাকা। গেলাম তার কাছে। বেশি কিছু বলতে হল না। অল্পতেই বুঝে গেল কি করতে হবে। তবে, আমার কাছ থেকে সে কোন টাকা নিবে না। উল্টো চটপুটি-ফুচকা যা ইচ্ছে তাই খাওয়া যাবে বিনে পয়সায়। বিনিময়ে সে আমার কাছে কিছু চায়না তা কিন্তু ভুল। তিন মাস আগে তার দোকানের আলু-পেঁয়াজ কাঁটার ছুরিটা নিয়ে ভোঁ দৌড়। পরের এক সপ্তাহ আমি তার নজর এড়িয়ে চলেছি। ঠিক তার পরের দিন ফুটবল খেলার সময় বল এক বন্ধুর নাকে লেগে রক্ত ঝড়তে থাকে। তাকে স্কুলের হাসপাতালে রেখে ফেরার সময় মামার মুখোমুখি সংঘর্ষ। সে আমার দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকরই কথা। গায়ে এবং হাতে লেগে থাকা রক্ত এখনও মোছা হয় নি।
ভালোয় ভালোয় মেট্রিকুলেশন পাশ করা হল। ও থুরি, এস.এস.সি। তারপর, বিভিন্ন কলেজ ঘোরাঘুরি করে পছন্দসই একটায় ভর্তি হলাম। কলেজের প্রথম বছর কিভাবে এলো আর কোন দিক দিয়ে গেল কিছুই বুঝলাম না। ভাগ্য ভালো সরকারি কলেজ। পরীক্ষার হলে পুরো এক বছরের গবেষণা শেষ করলাম। যা ভাবছো তা নয়। শুধু পাশের জনেরটা দেখে লিখেছি। ও হ্যাঁ আরেকটা কথা বলা হয়নি। অভিভাবক মিটিংয়ের পর স্কুলের সেই মামা ছয়শ টাকা পেয়েছে। কিন্তু, আমি আর তার ফ্রী খাবারও খাইনি এমনকি তার চোখের সামনেও পরিনি। স্কুলে থাকা অবস্থায় আমার একজন মাত্র বান্ধবী ছিল। কলেজেও আমরা একসাথে পড়েছি। শুধুমাত্র সেই জানে চটপটি ওয়ালার ধাঁরাল ছুরির হাদিস। কলেজ জীবনের দ্বিতীয় বর্ষে এসে আমি একটি মেয়ের প্রেমে পরে গেলাম। সবকিছু ভুলে জীবনকে সার্থক মনে করতে লাগলাম। সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকেও জানালাম সে কথা। সে শুধু শুনেই গেল। কিছু বলল না। আমারা প্রতিদিন কি কি কথা বলি না বলি এর সবই তাকে বলতাম। ও শুধুই শুনত। কখনও আমার প্রেমের ব্যাপারে কিছু বলতো না। বাঁশটা খেলাম নির্বাচনী পরীক্ষাতে। প্রেম করতে করতে তিন বিষয়ে ফেল। শেষ বাঁচা বাঁচলাম বান্ধবীর হাত ধরে। আমার হয়ে পুনঃপরিক্ষা গুলো সে দিল। কথা অনুযায়ী ফাইনাল পরিক্ষা পর্যন্ত প্রেম আমার টেবিল ক্লথের নিচে ভাঁজ করে রেখে দিলাম। যথা সময়ে রেজাল্ট পেলাম। ভালো, শুধুই ভালো। ভালোর আগে পরে কিছু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ফলাফল নাকি কারোও ভাল হয় না। তবে আশ্চার্যজনক ভাবে আমি আমাদের বিভাগে প্রথম হই। তবে এর পেছনে কারনও ছিল। এইচএসসি-র ফলাফলের পর আমি আর আমার বান্ধবীর কোন খবর পাইনি। এর পর থেকেই পড়ালেখার দায়ভার আমার কাঁধে এসে পরে। এভাবেই আমার পথচলা। বাবার কাড়িকাড়ি টাকা থাকা স্বত্তেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে এসে হলে সিট নিলাল। যেদিন ঘর থেকে প্রথম হলে আসবো সেদিন আমার প্রেম টেবিল ক্লথের নিচে পেলাম। হল জীবনের প্রথম এক মাস কিভাবে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যের পর পড়ার টেবিল গুছাতে গিয়ে হাতে পড়ল রুমের ছোট ভাইকে দেয়া তার বান্ধবীর চিঠি। আমি নির্বাক। এটা এলো কিভাবে? নিজের সম্মান রক্ষারথে কিছু বললাম না। চিঠিটা পড়লামও না। নিজের প্রেম বইয়ের ভাঁজ থেকে বের করলাম। ট্রেনের সতের বগির মত সতের পৃষ্ঠার আমার প্রেম। লেখাগুলো সব এলোমেলো। ভাগ্যিস পৃষ্ঠার নম্বর দেয়া ছিল। এগুলো আর কিছুই না, আমার কল্পনার জগতের আমার প্রেমের প্রতিচ্ছবি। ভালোলাগার, ভালবাসার সেই মানুষটি আর কেউ নয়। আমার সেই বান্ধবী।
এভাবে আর কত পালাবো? ছাত্রাবাসে ওঠার সপ্তম মাসে জড়িয়ে পড়লাম ছাত্র রাজনীতিতে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে সকলের সুনজরে পড়লাম। ক্ষমতার মোহ আমায় আঁকড়ে ধরলো। সাথে সুযোগ। এভাবেই চলতে লাগল জীবন। কতদিন এভাবে যাবে তাও জানিনা। পরন্ত বিকেলে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা শেষে করে সিগারেটটা মাত্র ধরিয়েছি। হঠাৎই চোখের সামনে দেখলাম প্রিয় সেই মুখটি। ব্যক্তিগত গাড়ির পেছন সিটে বসে আছে। পড়নে তার শাড়ি। চুলগুলো খোলা, কাঁধের বা পাশ দিয়ে সামনে রাখা। দু’হাত ভরা কাঁচের চুড়ি। ঠোঁটের কোনে এক টুকরো মিষ্টি হাসি। চোখের পলকে হারিয়ে ফেললাম। তাকে আর খুঁজে পেলাম না। ভিড়ের মাঝে তাকে তো পেলামই না, ওর গাড়িটাও চোখে পড়ল না। পহেলা বৈশাখের দিনের শুরুটা ভালোই হয়েছিল। কিন্তু, দিনের শেষে এমন হবে ভাবতেও পারিনি।
প্রস্তুতি পর্ব শেষ। সবকিছুই হাতের কাছে। সময় হলেই শুরু করবো। হাতে এখনও ঘণ্টা-খানেক সময় আছে। শেষবারের মত গীটারটা হাতে নিলাম। মনে মনে একটা সুর আওরাতে লাগলাম। কিন্তু হাতে এলো না। এমন সময় ঘট করে দরজা খুলে রুমে এল কয়েকজন বন্ধু। তাদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে রাত তিনটা। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। এখন নাকি আবার ল্যাপটপে ছবি দেখবে। চিল্লাপাল্লা করে সবাইকে বিদেয় করলাম। রুমেরটা অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। নাহ্ আজকের মত আবারও বেঁচে গেলাম। বিছানায় গেলাম সপ্নপরীর হাত ধরে। তারপর আর কিছুই মনে নেই। কিছুই না। সকালে আমার ফাইনাল পরীক্ষা।
বাড়ি থেকে প্রচন্ড চাঁপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। চাকুরীর প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। আমার পছন্দের কোন মেয়ে আছে কিনা, সেটাও জানাতে বলেছে। কিন্তু, আমি কি করে বলি আমার হারানো সেই প্রেমের কথা। যাকে আমি বহুদিন ধরে শুধুই খুঁজছি। যার বাস্তব অস্তিত্ব বলে কিছুই নেই।
“বহুদিন আগের কথা। আরব্য রজনীতে বাস করত এক রাজা আর এক রানি। তাদের ছিল দুই ছেলে মেয়ে। এক বিশাল প্রাসাদে তারা বাস করত………” গল্প শুনতে শুনতে আমাদের একমাত্র সন্তান ঘুমিয়ে পরেছে। কিন্তু, তার মা মানে আমার স্ত্রী একমনে এখনও গল্প বলে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি শুধুই ওর মায়াবি দুটো চোখের দিকে। এমন কি আছে ওর মাঝে যার মায়া কাঁটিয়ে উঠতে পারিনা। কেন আমাকে এত ভালোবাসো, কিসের নেশায়? আমাদের বিয়ের দুদিন আগেও আত্মহত্যার বৃথা চেষ্টা করেছি। এরপর আর কখনও সময় হয়ে ওঠেনি। ব্যস্ত এ জীবন, বিচিত্র সব সম্পর্ক। ক্ষণিকের ভালবাসা; কখনও হাসায়; কখনওবা কাঁদায়।
Be First to Comment